মহা শিব রাত্রির পূর্ণাঙ্গ পুজো পদ্ধতি এবং ব্রতকথা

প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথিতে গোটা দেশ জুড়ে পালিত হয় মহাশিবরাত্রি। শিব পুরাণ অনুসারে, এই দিন ভক্তি ভরে বাবার পুজো করলে এবং মহাশিবরাত্রির ব্রতকথা পাঠ করলে ভক্ত তার মনের মত বর প্রাপ্ত করতে পারে। ভোলেনাথ এইদিন ভক্তের সকল মনোকামনা পূরণ করতে পারে। পুরাণ মতে এই রাত্রেই ভগবান মহা তাণ্ডব নৃত্য করেছিলেন। আবার পুরাণ বলছে এই রাতেই শিব এবং পার্বতীর বিবাহ হয়েছিল। মূলত অজ্ঞানতার অন্ধকারের অভিশাপ দূর করে সৃষ্টিকে আলো পথ প্রদর্শন করতেই এই মহাব্রত পালন করা হয়। আজ আপনারা শিব রাত্রির ব্রত পালের নিয়ম, উপকরন, মন্ত্র ফলাফল এবং ব্রতকথা সম্পর্কে জানতে পারবেন।

    ব্রত পালনের নিয়ম –

    শিবরাত্রির আগের দিন নিরামিষ আহার গ্রহণ করতে হবে সঙ্গে রাতে ভূমি শয়ন করতে হবে। অর্থাৎ বিছানায় না শুয়ে খড় বা কম্বলে রাতে ঘুমোতে হবে। ব্রতের দিন সম্ভব হলে উপবাসী থাকতে হবে। যদি বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত শিব না থাকে তাহলে গঙ্গামাটি বা শুদ্ধ মাটি দিয়ে চারটি শিব লিঙ্গ গড়ে চার প্রহরে একটি করে শিবের পূজা করতে হয়। আর প্রতিষ্ঠিত শিব থাকলে তাতেই চার প্রহরে চারবার পূজা করতে হবে। প্রথম প্রহরে দুধ দিয়ে, দ্বিতীয় প্রহরে দই দিয়ে, তৃতীয় প্রহরে ঘি দিয়ে ও চতুর্থ প্রহরে মধু দিয়ে অভিষেক করাতে হয়। ব্রতের দিন সারা রাত জেগে বাবার পুজো করে পরদিন ব্রতকথা শ্রবণ করে, পারণ করতে হয়।

    ব্রতের উপকরণ –

    গঙ্গামাটি বা শুদ্ধমাটি, বেলপাতা, গঙ্গাজল, সাদা ফুল, দুধ, দই, ঘি, মধু এবং কলা। এছাড়া ধূপ, প্রদীপ সঙ্গে সাধ‍্যমত ভোগ।

    ব্রতের ফল –

    এই ব্রত পালন করলে ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ চতুর্বিধ ফেল লাভ হয়ে থাকে।

    চার প্রহরের অভিষেক দ্রব‍্য এবং মন্ত্র –

    প্রহরঅভিষেক দ্রব‍্যমন্ত্রঅর্ঘ্য মন্ত্র
    প্রথম প্রহরপ্রথম প্রহরে দুধ দিয়ে স্নান করাবেন।ইদং স্নানীয় দুগ্ধং হৌ ঈশানায় নমঃ।নমঃ শিবরাত্রিব্রত দেবপূজাজপপরায়ণঃ।
    করোমি বিধিবদ্দত্তং গৃহাণার্য্যং মহশ্বেরঃ।।
    দ্বিতীয় প্রহরদ্বিতীয় প্রহরে দই দিয়ে স্নান করাবেন।ইদং স্নানীয় দধি নমঃ হৌং অঘোরায় নমঃ।নমঃ শিবায় শান্তায় সর্বপাপ হরায় চ।
    শিবরাত্রৌ দদাম্যর্থ্যং প্রসাদী উময়া সহ।।
    তৃতীয় প্রহরতৃতীয় প্রহরে ঘি দ্বারা স্নান করাবেন।ইদং স্নানীয় ঘৃতং নমঃ হৌং বামদেবায় নমঃ।নমঃ দুঃখ দারিদ্র্য শোকেন দগ্ধোহহং পার্বতীশ্বরঃ।
    শিবরাত্রৌ দদাম্য্যং উমাকান্ত গৃহাণ মে।।
    চতুর্থ প্রহরচতুর্থ প্রহরে মধু দ্বারা স্নান করাবেন।ইদং স্নানীয় মধু নমঃ হৌং সদ্যোজাতায় নমঃ।নমঃ ময়া কৃতান্যমেকানি পাপানি হর শঙ্করঃ।
    শিবরাত্রৌ দদার্য্য্যং উমাকান্ত গৃহাণ মে।।
    পারণ ওঁ সংসার স্লেশদগ্ধস্য ব্রতনামেন শঙ্করঃ।
    প্রসাদী সুমুখো নাথ জ্ঞানদৃষ্টি প্রদো ভব।।

    শিব রাত্রির ব্রতকথা –

    এক বনে এক ব্যাধ বাস করত। ভারী হিংসুক সে। মৃগ হত্যা তার পেশা। সে জীবনে কখনও। কোনো শুভ কাজ করে নি, কেবল পাপ কাজই করেছে।

    একদিন শিবচতুর্দশীর মহাব্রত এল। ব্যাধ ওসবের কিছুই জানে না। সকাল হতেই বেরিয়ে পড়ল। শিকারে। সেদিন তার ঘরে খাবার কিছুই নেই, তাই না খেয়েই চলে গেল বনের ভিতরে। কিন্তু সেদিন যে কি হল, তার ভাগ্যে একটা শিকারও জুটল না। এ বনে সে বনে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়ল সে। কখন যে সূর্য্য অস্তাচলে গেল সে খেয়াল তার নেই। যখন খেয়াল হল, তখন সে চিন্তা করল-হায়। সাবাটা দিন ঘুরে একটাও শিকার পেলাম না। ঘরেও কোন খাবার নেই, বাচ্চারা না খেতে পেয়ে কত কষ্ট পাচ্ছে। হোক রাত, রাত্রিতেই কোন শিকার ধরে তবে ঘরে ফিরব। তারপর সে ঘুরতে ঘুরতে একটা জলাশয় দেখতে পেল। মনে ভাবল-রাত্রিবেলা হরিণ এই। জলাশয়ে জল খেতে আসবে, তখনই শিকার করব। কিন্তু রাত্রিবেলা যদি বাঘ এসে আমাকে আক্রমণ। করে, তাহলে কি করব এই চিন্তা করে। আবার যদি তেষ্টা পায়, তাই খানিকটা জল নিয়ে সেখানকার একটি গাছে চড়ে বসল। সব সময় লক্ষ্য করছে-কখন কোন প্রাণী আসে। ব্যাধের সমস্ত দিন কিছু খাবার জুটে নি, রাত্রিতে বসে রইল গাছে।

    ঘটনাচক্রে গাছটি ছিল বেলগাছ, গাছের নীচেই ছিল একটি শিবলিঙ্গ। ব্যাধ গাছের ডালে বসে নড়ে চড়ে উঠতেই একটি বেলপাতা খসে পড়লো সেই শিবলিঙ্গের মাথায় এবং ব‍্যাধের সঙ্গে থাকা জলও পড়ল শিব লিঙ্গের উপর। সেদিন ছিল শিবচতুদ্দশী। ব্যাধও ছিল উপবাসী, তাই শিবের মাথায় বেলপাতা পড়তে শিব সন্তুষ্ট হলেন। ব্যাধ এসব কিছুই জানতো না। তবুও তার শিবচতুৰ্দ্দশী ব্রতের ফল লাভ হলো। সকালে ব্যাধ তার নিজের বাড়ি ফিলে এলো। ব্যাধ ফিরে আসতে তাকে তার স্ত্রী তাকে খেতে দিল। এমন সময় একজন অতিথি এলন। ব্যাধ কি ভেবে তার খাবারগুলি অতিথিকে খেতে দিয়ে দিলেন। তাতে তার পারণের ফলও লাভ হলো। কিছুদিন বাদে ব্যাধ অসুস্থ হয়ে মারা গেল। যমদূতরা তাকে নিয়ে যাবার জন্যে এলো, এমন সময় সেখানে হাজির হল শিবদূতেরা। দু’ পক্ষের যুদ্ধ বেধে গেল, যমদূতরা হেরে গেল এবং শিবদূতরা ব্যাধকে কৈলাসে নিয়ে এলো। যমদূতরাও তাদের পিছনে পিছনে ধাওয়া করলো। কৈলাসের দ্বারে নন্দী পাহারা দিচ্ছিল, সে যমদূতদের কাছে ব্যাধের শিবরাত্রির কথা বললো। সব শুনে যমদূতরা ফিরে গিয়ে যমকে সব জানালো। যম বললেন-হ্যাঁ, যে শিব বা বিষ্ণুর ভক্ত আর যে শিবচতুদ্দশী ব্রত করে এবং যে বারাণসীধামে মারা যায়, তার ওপর আমার কোন অধিকার থাকে না। তারপর থেকে এই ব্রতের কথা চারিদিকে প্রচার হতে থাকল ।

    অথ শিবরাত্রি ব্রতকথা সমাপ্ত

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *