বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ হল নর্মদা নদীর উপত্যকায় প্রাপ্ত এক ধরনের মসৃণ উপবৃত্তাকার পাথর বিশেষ যা শিব লিঙ্গ আকারে পুজো করা হয়। বাণলিঙ্গ বা বাণেশ্বর শিবলিঙ্গকে স্বয়ম্ভু লিঙ্গ বলা হয় অর্থাৎ যা মানুষ দ্বারা সৃষ্ট নয় যা ঈশ্বর নিজে থেকেই সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাই বাণলিঙ্গকে শিবের সাক্ষাৎ চিহ্ন মনে করা হয়। এই বাণলিঙ্গে সর্বদা সদাশিবের অধিষ্ঠান করেন। আজ আপনারা এখানে জানবেন বাণেশ্বর শিবলিঙ্গের উৎপত্তির পৌরাণিক কাহিনী ও গুরুত্ব এবং বাণেশ্বর শিবলিঙ্গের সকল গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র সমূহ।
Table of Contents
◆ বাণেশ্বর শিবলিঙ্গের উৎপত্তির পৌরাণিক কাহিনী
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে বাণ নামে এক শিব ভক্ত অসুর ছিল। তিনি শিবক্ষেত্র নর্মদাতীরে প্রতিদিন শিব লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করে ভক্তিভরে পুজো করত। শিব তার ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর চাইতে বলেন। বাণ শিবের কাছে বর হিসেবে চাইলেন উত্তম লঙ্গণ যুক্ত শিব লিঙ্গ। শিব তাকে চোদ্দ কোটি শিব লিঙ্গ দান করে। বাণ এই শিব লিঙ্গ গুলো যাতে সকলের উপকারে আসে তাই সে এই শিব লিঙ্গগুলৌ পুজো করে বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করেন।যেমন তিন কোটি লিঙ্গ কালিকাগর্তে স্থাপন করেন, তিন কোটি লিঙ্গ শ্রীশৈলে, এক কোটি কন্যাশ্রমে, এক কোটি মহেশ্বর ক্ষেত্রে এবং অবশিষ্ট লিঙ্গগুলি বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে স্থাপন করেন। বাণ দ্বারা পূজিত এই সকল শিবলিঙ্গ পৃথিবীতে বাণলিঙ্গ বা বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ নামে খ্যাত। ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এইসব শিবলিঙ্গ। এই শিবলিঙ্গ মূল বিশেষত্ব হল এই লিঙ্গ একবার মাত্র পূজিত হলেই সহস্রবার পূজার ফলদান করে।
◆ বাণেশ্বর শিবলিঙ্গের গুরুত্ব :
বৃহৎ বৈবর্ত পুরাণে তিন প্রকার শিব লিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন স্বয়ম্ভু অর্থাৎ যা স্বপ্রতিষ্ঠিত, বাণলিঙ্গ ও শৈললিঙ্গ। এরমধ্যে বাণেশ্বর শিবলিঙ্গকে অন্যতম পবিত্র শিবলিঙ্গ বলা হয়। এই বাণেশ্বর শিবলিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায় আছে রামায়ণ, মহাভারত সহ বিভিন্ন পুরানে। এছাড়াও টলেমির রচনা ও পেরিপ্লাস গ্রন্থে এই বাণলিঙ্গের উল্লেখ মেলে। বাণেশ্বর শিবলিঙ্গের উৎপত্তি স্থল মূলত নর্মদা নদী। এই নর্মদা নদীর অপর নাম ‘রেবা’ যার উৎপত্তি সংস্কৃত ‘রেব’ শব্দ থেকে। এই রেব শব্দের অর্থ হল পাথুরে নদী। বায়ু পুরাণ এবং স্কন্ধ পুরাণ অনুসারে নর্মদা নদীর উৎপত্তি শিবের অঙ্গ থেকে। নর্মদা নদীকে বলা হয় শঙ্করী অর্থাৎ শিবের কন্যা।
বাণলিঙ্গের পুজো পঞ্চদেবতার পুজোর একটি বিশেষ অঙ্গ। বলা হয় বাণলিঙ্গের পুজো করলে ভক্তের সকল মনোকামনা পূরণ হয়।
◆ বাণলিঙ্গের প্রকারভেদ:
বাণলিঙ্গও রূপ এবং বৈশিষ্ট্য ভেদে ৯ প্রকারের হয়ে থাকে যথা-১) ঐন্দ্রলিঙ্গ, ২) বারুণলিঙ্গ, ৩) বৈষ্ণবলিঙ্গ, ৪) আরুণলিঙ্গ, ৫) যাম্যলিঙ্গ, ৬) আগ্নেয়লিঙ্গ, ৭) রাক্ষসলিঙ্গ বা নৈঋতলিঙ্গ, ৮) বায়ুলিঙ্গ ও ৯) কুবেরলিঙ্গ বা রুদ্রলিঙ্গ।
◆ বাণেশ্বর শিবলিঙ্গের সকল গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র সমূহ :
◆ বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ ধ্যানমন্ত্র
ওঁ প্রমত্তং শক্তি সংযুক্তং বাণাখ্যাঞ্চ মহাপ্রভুং, কামবাণান্বিতং দেবং সংসার দহনক্ষমম্। শৃঙ্গারাদি – রসোল্লাসং বাণাখ্যাম্ পরমেশ্বরম্।।
◆ বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রণাম মন্ত্র
ওঁ বাণেশ্বরায় নরকার্ণবতারাণায় জ্ঞানপ্রদায় করুণামৃত সাগরায়। কপূর-কুন্দ-ধবলেন্দু-জটাধরায় দারিদ্র্য দুঃখ দহনায় নমঃ শিবায়।।
◆ বাণেশ্বর শিবলিঙ্গের জপ মন্ত্র :
ওঁ হৌং বাণেশ্বরায় শিবায় নমঃ।।
◆ বাণলিঙ্গ স্তোত্রম্ :
বাণলিঙ্গ মহাভাগ সংসারাৎ ত্রাহি মাং প্রভো।
নমস্তে চোগ্ররূপায় নমস্তেহব্যক্তযোনয়ে ॥
সংসারহারিণে তুভ্যং নমস্তে সূক্ষ্মরূপধক।
প্রমত্তায় মহেন্দ্রায়কালরূপায় বৈ নমঃ ॥
দহনায় নমস্তুভ্যং নমস্তে যোগকারিণে।
ভোগিনাং ভোগকর্তে চ মোক্ষদাত্রে নমো নমঃ ॥
নমঃ কামাঙ্গনাশায় নমঃ কল্মষহারিণে।
নমো বিশ্ব প্রদাত্রে চ নমো বিশ্বস্বরূপিণে ॥
বাণস্য বরদাত্রে চ রাবণস্য ক্ষয়ায় চ।
রামসানুগ্রহাথায় রাজ্যায় ভরতস্য চ ॥
মুনীনাং যোগাদাত্রে চ রাক্ষসানাং ক্ষয়ায় চ।
নমস্তুভ্যং নমস্তুভ্যং নমস্তুভ্যং নমো নমঃ ॥
ঐং দাহিকাশক্তিযুক্তায় মহামায়াপ্রিয়ায় চ।
ভক্তপ্রিয়ায় সর্বায় বৈরিণাং নিগ্রহায় চ ॥
যোগিনামধিরাজায় কেলিকানাং প্রিয়ায় চ।
কুলাঙ্গনানীং ভক্তায় কুলাচাররতায় চ ॥
কুলভক্তায় যোগায় নমো নারায়ণায় চ।
মধুপান প্রমত্তায় যোগেশীয় নমো নমঃ ॥
কুলনিন্দা প্রণাশায় কৌলিকানাং সুখায় চ।
কূলযোগায় নিষ্ঠায় শুদ্ধায় পরমাত্মনে ॥
পরমাত্মস্বরূপায় লিঙ্গমূলাত্মকায় চ।
সর্বেশ্বরায় সায় শিবায় নিখুঁণায় চ ॥
ইত্যেতং পরমং গুহ্যং বাণলিঙ্গস্য সংস্কৃতম।
যঃ পঠেৎ সাধকশ্রেষ্ঠ গাণপত্যং সভেত সঃ ॥
স্তবস্যাস্য প্রসাদেন নরো যযাগিত্বময়াৎ।
রাজ্যার্থ লভতে রাজ্যং ভাগিনাং ভোেগ এব চ ॥
যং যং কাময়তে কামী, তং তমাখোতি লীলয়া।
বাণলিপ্রসাদেন সর্বমাগ্লোতি সত্বরম্ ॥
কিমন্যৎ কথয়ামীহ সর্বং বেৎসসি কুলেশ্বর।
মহাভিয়ে সমুৎপন্নে রাজদ্বারে বনানলে ॥
অরণ্যে প্রান্তরে বাপি দস্যুচৌরাগ্নিসঙ্কুলে।
পঠনাৎ স্তবরাজস্য ন ভয়ং বিদ্যতে কচিৎ ॥
বাণলিঙ্গস্য মাহাত্ম্যং সংক্ষেপাৎ কথিতং ময়া।
তস্য বরণমাত্রেণ নরো মোক্ষমবাকুয়ৎ ॥
বাণলিঙ্গং সদারাধ্যং যোগীনাং যোগসাধনে। কৌলিকানাং কুলাচারে পশূনং শনিগ্রহে ॥
বেদনাং বেদপাঠে রোগীনাং রোগনাশনে।
যস্ত নারাধয়েদেনং তস্য সর্বং সুনিষ্ফলম্ ॥
। ইতি শ্রীযোগসারে বাণলিঙ্গস্তোত্রম্ ।
বাণলিঙ্গের মধ্যে পারদলিঙ্গকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। শাস্ত্রে পারদকে রুদ্রের বীর্য বলা হয়েছে। বলা হয় এককোটি রত্নলিঙ্গ পূজা করলে ভক্ত যে ফল পায় একটিমাত্র বাণলিঙ্গ পূজার দ্বারা ভক্ত সেই ফল প্রাপ্ত করে। আবার কোটি বাণলিঙ্গ পূজার ফল একটি পারদ লিঙ্গের পূজাতে লাভ হয়।
◆ পারদ লিঙ্গের মন্ত্র সমূহ :
◆ পারদ লিঙ্গের জপ মন্ত্র –
ওঁ নমঃ ভগবতে পারদেশ্বরায় নমঃ শিবায়
◆ পারদ লিঙ্গের স্থাপন মন্ত্র –
ওঁ হ্রীং নমঃ শিবায় হ্রীং ওঁ
◆ পারদ শিব লিঙ্গের পূজা মন্ত্র –
ওঁ নমঃ ভগবতে পারদেশ্বরায় নমঃ শিবায়
◆ পারদ শিবলিঙ্গ স্নান মন্ত্র –
ওঁ হ্রীং নমঃ শিবায় হ্রীং ওঁ।
◆ ভিন্ন পদার্থে তৈরী শিবলিঙ্গ স্নান মন্ত্র-
হরি ওঁ নমঃ শিবায়।