বাংলায় সংক্ষিপ্ত সুন্দরকান্ড পাঠ এবং এর উপকারীতা

All about Sundarkand / Sundarkand in Short and its Benifits 

Sundarkand


সুন্দরকান্ড রামায়ণের একমাত্র অধ্যায় যেখানে নায়ক রাম নন, বরং হনুমান।  রচনাটিতে হনুমানের দুঃসাহসিকতা এবং তাঁর নিঃস্বার্থতা, শক্তি এবং রামের প্রতি নিষ্ঠার চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। হনুমানকে তাঁর মাতা অঞ্জানী “সুন্দর” নামে অভিহিত ডাকতেন। তাই হনুমানজী এই অধ্যায়ের নায়ক বলে এই অধ্যায়ের নাম ” সুন্দরকান্ড ” বেছে নেওয়া হয়েছে। ” সুন্দরকান্ড ” বাল্মীকি রচিত রামায়নের পঞ্চম অধ্যায়। এখানে রাবণ সীতা মাতাকে ছল করে অপহরণ করে নিয়ে গেলে হনুমানজী কর্তৃক সীতা মাতাকে উদ্ধারের বীরত্বের কহিনী বর্ণনা করা রয়েছে।


সুন্দর কান্ডের মুখ্য চরিত্র গুলো হল : হনুমানজী যিনি এই অধ্যায়ের মূল নায়ক, সীতা মাতা যিনি শ্রীরামের স্ত্রী এবং রাবণ এনাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়, শ্রীরাম মূল রামায়ণের নায়ক, রাবণ যিনি সুন্দর কান্ড তথা মূল রামায়ণের খলনায়ক হিসেবে পরিচিত এবং জাম্বুবান যিনি ভাল্লুক কুলের রাজা।

সুন্দর কান্ডের প্রারম্ভ :

জাম্বুবানের দ্বারা হনুমানের প্রশংসা মারফত রামায়ণের পঞ্চম অধ্যায় সুন্দর কান্ড শুরু হয়। জাম্বুবানের প্রশংসার বাক্য শ্রবণের পর হনুমানজী মাতা সীতার সন্ধানের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

মহাসাগরে হনুমানের পথে প্রথম বাধা – মৈনাক পর্বত : 

আজকে আমরা সমস্ত পর্বতমালা গুলোকে স্থারব অবস্থায় দেখি কিন্তু হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এক সময় এই পর্বগুলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে উড়ে যেতে পারত। কিন্তু এর জন্য অনেক মানুষের প্রান হানি ঘটত। তাই দেবরাজ ইন্দ্র এই পর্বগুলোর ডানা ছাটতে শুরু করেন। এই সময়কালে মৈনাক পর্বতটি ভয়ে সমুদ্রের মধ্যে লুকিয়ে ছিল যাতে ইন্দ্র তাকে খুঁজে না পান। যখন সমুদ্র বুঝতে পেরেছিল যে, হনুমানজী সমুদ্র পার হচ্ছেন, তিনি মৈনাক পর্বতকে মহাসাগর থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে শ্রী হনুমান পাহাড়ে বিশ্রাম নিতে পারেন।  যদিও হনুমান মৈনাকের অনুরোধ মেনে নিয়েছিলেন, তবে তিনি বিশ্রাম নেন নি কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে এটি তাঁর যাত্রায় বাধা।

নাগ মাতা সুরসা দ্বারা হনুমানজীর শক্তি পরীক্ষা :

Surasa against Hanuman ji

                     Pic : Wikipedia 
স্বর্গের সমস্ত দেবতা হনুমানজীর প্রজ্ঞা, জ্ঞান এবং শক্তি পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন, তাই তারা সর্প মাতা “সুরসাকে” প্রেরণ করেছিলেন। সুরসা দৈত্যাকার রাক্ষসীর রুপ ধারন করে হনুমানজীর পথ আটকে দেন এবং বলেন যে কেউ এই পথ দিয়ে যেতে গেলে তার মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে তবেই যাওয়া যাবে। এই কথা শুনে হনুমান নিজের শরীরের আকৃতি বিশালাকার করে তোলেন। হনুমানের বিশালাকৃতি দেখে সুরসাও নিজের মুখের আকৃতি বিশালাকার করে তোলে। এইবার হনুমান হঠাৎ করে নিজেকে তার ক্ষুদ্র অবতার ধারণ করেন এবং তাঁর মুখের মধ্যে প্রবেশ করেন এবং নাক থেকে বেরিয়ে আসেন। এই ভাবে তিনি সমস্ত দেব দেবীর কাছে নিজের জ্ঞান এবং দক্ষতার পরিচয় দিলেন এবং বাধা দূর করলেন।

দানবী সিংহিকা বনাম হনুমানজী :

Hanuman encounters Surasa, depicted in top register. Simhika and Lankini in mid and lower registers
Picture : Wikipedia 


আকাশ ও সাগরে দুটি বাধার সম্মুখীন হওয়ার পরে হনুমান তাঁর তৃতীয় বাধা দানবী সিংহিকা নামক এক দানবীর বাধায় পড়েছিলেন। এই সিংহিকা দানবী তার ক্ষমতা বলে হনুমানজীর ছায়া ধরে তাকে গিলে ফেলেছিল। হনুমানজী দানবীর শরীরের ভেতরে গিয়ে তার ভেতরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নষ্ট করে তাকে হত্যা করে। এইভাবে হনুমানজী তার তৃতীয় বাধা বীরত্বের সঙ্গে দূর করেন।

লঙ্কার অতন্দ্র প্রহরী রাক্ষসী লঙ্কিনী বনাম হনুমান :

উপরের তিন বাধার সম্মুখীন হবার পর লঙ্কার প্রবেশ দ্বারে সমুদ্র তটে হনুমানজী বাধা পান লঙ্কার পাহারাদার লঙ্কিনীর কাছে। হনুমানজী রাতে সবার অলক্ষে লঙ্কায় প্রবেশ করার পরিকল্পনা করলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী হনুমানজী রাতে যখন লঙ্কায় প্রবেশ করতে যাবেন তখনই তিনি লঙ্কার অতন্দ্র প্রহরী রাক্ষসী লঙ্কিনীর সম্মুখীন হন। তিনি হনুমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন কিন্তু যখন তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি একজন অনুপ্রবেশকারী তখন তিনি তাকে আক্রমণ করেন এবং সেই লড়াইয়ে লঙ্কিনী পরাস্ত হন।

লঙ্কিনী ছিলেন ব্রহ্মার বাসস্থানের একজন প্রহরী। ব্রহ্মার অভিশাপে তাকে রাক্ষস কুলের বাসভবনের প্রহরী হতে হয়েছিল। ব্রহ্মা তাকে বলেছিলেন যে, সে তখনই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবেন যখন কোনও বানর তাকে যুদ্ধে পরাজিত করবে এবং এভাবেই তার অভিশাপের অবসান ঘটবে।কিছুক্ষণ পরে তিনি বুঝতে পারলেন যে এই বানরটি কোনও সাধারণ বানর নয়। তিনি ব্রহ্মার অনুগ্রহের কথা স্মরণ করেন।তত্ক্ষণাত লঙ্কিনী হনুমানের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন এবং তিনি বুঝতে পারেন যে ব্রহ্মার  ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হতে চলেছে।

হনুমানজীর সঙ্গে রাবণ ভ্রাতা বিভীষনের সাক্ষাৎ এবং সীতার অবস্থান সম্পর্কে ধারনা :

হনুমানজী তখন সীতার সন্ধানে লঙ্কার রাজ প্রাসাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তখনই তিনি তার বিভীষণের সাথে সাক্ষাত হয় যিনি তাকে সীতার গোপন অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বিভীষণ রাক্ষস রাজ রাবণের ভ্রাতা হলেও তিনি কোন ভাবেই রাবণ দ্বারা সীতার অপহরণ মেনে নিতে পারেন নি। তিনি রাবণকে অনুরোধ করেন যে সীতাকে মুক্তি দিয়ে রামের কাছে ফেরত পাঠাতে। কিন্তু তাতে রাজি না হওয়ায় তিনি রাবণের এই অধর্ম মেনে নিতে পারেন নি। তাই তিনি রাবণের পক্ষ ছেড়ে রামের পক্ষে চলে যান। 

তিনি অশোক ভাটিকার দিকে রওনা হলে যেখানে তিনি দেখেন যে রাবণ সীতাকে বিবাহের জন্য হুমকি দিচ্ছেন।

হনুমানজীর সঙ্গে অপহৃত মাতা সীতার সাক্ষাৎ :

Hanuman meets Sita
Pic: Wikipedia 


হনুমানজী সীতা মাতাকে বিভীষনের পরামর্শ মত অশোক ভাটিকায় খুঁজতে এলে তিনি দেখতে পান সীতা মাতা অনেক রাক্ষসী দ্বারা বেষ্টিত ছিলেন।  একই সাথে রাবণ অশোক ভাটিকায় প্রবেশ করে সীতা মাতাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলেন এবং রাবণ সীতাকে তাঁর সাথে বিয়ে করার দাবি করেছিলেন, কিন্তু সীতামাতা তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।  রাবণ রাগান্বিত হয়ে তাকে হত্যা করার জন্য সীতার দিকে এগিয়ে গেলে তার স্ত্রী তাকে তা করতে বাধা দেন।  এই সময়ে, “ত্রিজাতা” নামে এক অসুরী ছিল, যিনি সীতা মাতার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন তিনি তাকে অভয় এবং উৎসাহ প্রদান করেছিলেন।

হনুমানজী শ্রীরামের একজন বার্তা বাহক হিসাবে সীতা মাতার সামনে উপস্থিত হলেন এবং প্রভু শ্রী রামের আংটি সীতা মাতার সামনে উপস্থাপন করলেন। মাতা সীতা হনুমান কে জিজ্ঞাসা করলেন যে তার স্বামী রামজী এবং রামজীর ভ্রাতা লক্ষ্মণজী কেমন আছেন? হনুমানজী তাকে উওর করলেন যে দুজনেই শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন কিন্তু তাদের মনে প্রচুর দুঃখ রয়েছে।  হনুমানজী তাঁকে শ্রী রামের বার্তা দিলেন – “ওহে সীতা, তোমার চলে যাওয়া আমাকে খুব অসুখী করেছে।  সবকিছু এতটাই অকেজো বলে মনে হচ্ছে যেন গাছে নতুন পাতা আগুনের মতো দেখায় এবং রাতগুলি গাঁঢ় অন্ধকার মনে হয়। রাতের চাঁদ দেখতে কেবল একটি ছোট তারা,বৃষ্টি ঠান্ডা জলের পরিবর্তে তেলের মতো অনুভব করায়।  বাতাস গরম এবং বিষাক্ত বোধ হয় ।  যে জিনিসগুলি তখন  প্রচুর আনন্দ প্রদান করত সেগুলি এখন প্রচুর ব্যথা দেয়।  আমার দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার মতো কেউ আর নেই। আমাদের তোমার প্রতি ভালবাসার গভীরতা কেউ জানে না, কেবল আমার মন তা জানে এবং সেই মনটি তোমার সাথে রয়েছে ”।


সীতা মাতা সংশয় প্রকাশ করলেন যে, রাবণের মত এক শক্তিশালী রাক্ষসের সঙ্গে সামান্য এক বানর কিভাবে লড়াই করতে পারে? হনুমানজীও তার সন্দেহ দূর করতে তার সত্যিকারের বৃহৎ এবং শক্তিশালী রুপ ধারন করে।

হনুমানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য রাবণের তার পুত্র মেঘনাথকে প্রেরণ :

হনুমানজী সীতার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে অশোক ভাটিকার গাছ থেকে ফল খেতে শুরু করলেন ।  সমস্ত ফুল ভেঙে, গাছ উপড়ে ফেলে এমনকি রাবণের কয়েকজন সৈন্যকে হত্যা করে তিনি সেখানে ত্রাস সৃষ্টি করলেন।  খবরটি খুব তাড়াতাড়ি রাবনের কাছে পৌঁছে যায়। রাবণ তাঁর সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করে হনুমানজীকে নিয়ন্ত্রণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন।  প্রাথমিক সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে রাবণ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তার পুত্র মেঘনাদকে হনুমানজীকে আটক করে আনতে পাঠায়।  তাকে আটক করে বাঁধতে মেঘনাথ রাখতে হনুমানজীর বিরুদ্ধে ব্রহ্মাস্ত্র এবং নাগপাশ অস্ত্র ব্যবহার করতে বাধ্য হন।  মেঘনাথ হনুমানকে আটক করে রাবনের দরবারে নিয়ে যান।হনুমানজী রাবণের দরবারে রাবণকে  বলেছিলেন যে তিনি ভগবান শ্রী রামের একজন বার্তাবাহক, যার স্ত্রী প্রতারণার শিকার হয়ে আপনার কাছে আটক।  হনুমানজী রাবনকে অত্যন্ত ধার্মিক পরিবার থেকে আসার কারণে সীতা মাতাকে সসম্মানে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন।  শ্রী রাম তাকে ক্ষমা করবেন কারণ তিনি করুণার সাগর এবং কখনও তাঁর ভক্ত বা যারা তাঁর আশ্রয় নেন তিনি তাদের কখনও অস্বীকার করেন না।  তিনি তাকে আরও বলেছিলেন যে তিনি শ্রী রামের বিরুদ্ধে গেলে শিব, বিষ্ণু ও ব্রহ্মা তাকে সাহায্য করবেন না।  তিনি তাকে নিজের অহং ত্যাগ করতে বলেছিলেন এবং ভক্তি, জ্ঞান এবং বৈরাগ্য সম্পর্কে প্রচুর উদাহরণ দিয়েছেন যা রাবণ এক গর্বিত সুরে উত্তর দিয়েছিল যে সে একজন জ্ঞানী বানরকে আটক করেছে। হনুমানের এই কথা শুনে রাবণ হনুমানের লেজ আগুনে পুড়িয়ে দিতে আদেশ করেন। 

হনুমানজীর লঙ্কা দহন :

Hanuman burn Lanka
Pic : Wikipedia 

রাবণ হনুমানজীকে উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য তার লেজ পুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন, হনুমানজীও তার শরীরের আকার বাড়িয়ে নেন। কথিত আছে যে লেজ পুড়িয়ে ফেলার জন্য প্রচুর কাপড় ও তেল দরকার ছিল।  অবশেষে, যখন হনুমানের লেজ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন সে তার আকার হ্রাস করে এবং লেজ দিয়ে পুরো লঙ্কা নগরীতে আগুন ধরিয়ে দেন।  এভাবেই রামায়ণের সুন্দরীকান্ডে লঙ্কা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

হনুমানজী সীতা মাতার সাথে সাক্ষাৎ এবং আবার কিশকিন্দার দিকে ফিরে যাওয়া :

হনুমানজী সীতার সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাঁর কাছে ফিরে প্রভু শ্রীরামের দিকে ফিরে যেতে অনুমতি চান। সীতা তার একটি হাতের চুড়ি বের করে হানুমানজিকে রামের জন্য দিয়েছিলেন।  এরপরে তিনি হনুমানজীকে শ্রীরামের উদ্দেশ্যে এই বার্তা দিলেন যে তিনি যাতে তাকে আশীর্বাদ করেন এবং তাদের সমস্ত বাধা অপসারণ করে যদি তিনি এক মাসের মধ্যে তাকে উদ্ধার না করেন তবে তিনি কখনই তাকে হয়ত দেখতে পাবেন না।

হনুমানজী কিসকিন্দা ফিরে গেলে শ্রীরাম হনুমানকে প্রথমে আলিঙ্গন করলেন এবং তারপরে তাকে সীতার প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন।  হনুমানজী সীতা মাতা এবং তার বার্তার একটি বিশদ বিবরণ প্রভু রামের কাছে পেশ করেন।  তিনি রামকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে তিনি যখন তিন জগতের প্রভু তখন কেন তিনি তাঁর স্ত্রীকে উদ্ধার করতে এত দেরী করছেন? তাঁর কথা শুনে রামের চোখে জল এসে যায় এবং তিনি হনুমানকে বলেন যে সীতা তাঁর মন ও আত্মা এবং তাঁর স্বপ্নেও কেউ কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। শ্রী রাম তখন সুগ্রীবকে আদেশ করেন যে তাদের উচিত লঙ্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার প্রস্তুতি নেওয়া। 

মন্দোদরী এবং বিভীষন উভয়ের দ্বারাই রাবণকে বোঝানোর চেষ্টা :

হনুমান দ্বারা লঙ্কায় এত ক্ষয়ক্ষতি দেখে ভবিষ্যতে এর আরও ভয়ংকর ক্ষতির আশঙ্কা করে রাবণের স্ত্রী মন্দোদরী এবং ভ্রাতা বিভীষন দুজন মিলেই রাবণকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তিনি যাতে যুদ্ধ বন্ধ করেন এবং সীতাকে ফেরত পাঠান। বিভীষন তাকে সাবধান করে বলেন যে কাম এবং ক্রোধ সবসময় ধ্বংস ডেকে আনে। তারা আরও জানান যে তিনি যদি যুদ্ধ বন্ধ করে সীতাকে ফেরত পাঠান তবে ব্রহ্মা এবং শিব প্রসন্ন হবেন। কিন্তু রাক্ষস রাজ রাবণ তাদের কথায় কোন প্রকার কর্নতো পাত করেন নি বরং তিনি বিভীষনের ওপর ক্ষুব্ধ হন এমনকি তিনি তাকে রাজ সভায় চরম অপমান করেন। বিভীষন তখন ভগবান রামের সাথে দেখা করেন এবং তারপরে তাঁর বন্ধুত্বের জন্য অনুরোধ করেন।  রাম আনন্দের সহিত তাকে তাঁর বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেন।

বিভীষন ও শ্রীরামের সাক্ষাৎ :

Bibhisana meets Ram


রাবণের সঙ্গ ত্যাগ করে বিভীষন শ্রীরামের শরনাপন্ন হন। তিনি শ্রীরামকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন যে তিনি রাক্ষস রাজ রাবণের ভাই তার একটি তামসিক শরীর রয়েছে যা পাপে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। তিনি সাহায্যের জন্য এবং আশ্রয়ের জন্য শ্রীরামের কাছে এসেছেন। এই কথা শুনে শ্রীরাম বিভীষনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন যে তিনি যদিও পাপ এবং নিষ্ঠুরতার মধ্যে এতদিন ছিলেন তবুও তিনি সত্যের পাশেই ছিলেন। এই কথা শুনে বিভীষন বলেছিলেন যে তিনি শ্রী রামের পা স্পর্শ করার সুযোগ পেয়েছেন, তিনি জীবনে আর কিছু চান না। 

শ্রীরামের মহাসাগর থেকে অনুমতি  :


শ্রীরাম সুগ্রীব ও বিভীষণকে জিজ্ঞাসা করেন যে তারা কীভাবে শক্তিশালী মহাসাগরটি অতিক্রম করবেন।  বিভীষন জবাব দিয়েছিলেন এ বিষয়ে সমুদ্র থেকেই অনুমতি এবং সমাধান জিজ্ঞাসা করা অধিক সম্মানজনক হবে।  রাবণ তার দুই সৈন্যকে ছদ্মবেশে প্রেরণ করলে, সুগ্রীব তাদের চিনে ফেলে এবং বন্দী করে লক্ষ্মণের কাছে নিয়ে যায়।  লক্ষ্মণ রাবণকে শ্রী রামের পায়ে আশ্রয় নেওয়ার বার্তা দিয়ে দুই বন্দিকে মুক্ত করেন।  

শ্রীরাম সমুদ্রের তীরে পাঁচ দিন অনুমতি পাবার জন্য অপেক্ষারত ছিলেন কিন্তু কোন উওর না পেয়ে শ্রীরাম লক্ষণকে তার তীর ধনুক চাইলে সমুদ্র তার ভুল বুঝতে পারেন। তিনি ব্রাহ্মনের বেশে রামের সামনে উপস্থিত হন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তারপরে মহাসাগর তাকে নল ও নীল এবং জলে ফেলে দেওয়া পাথর বা শিলা পাথর যে গুলো জলে সবসময় ভেসে থাকবে কখনই ডোবে না সেই সম্পর্কে অবগত করেন।  

উপরিউক্ত গল্পর মাধ্যমে আমরা সকলকেই বুঝতে পারছি যে এই সুন্দর কান্ডে হনুমানজীর রাম রাবণের যুদ্ধে অবদানের গুন কীর্তন করা হয়েছে। এই বিশেষ কান্ড হনুমানজীর জন্য উৎসর্গীকৃত। সুন্দর কাণ্ড সেই গল্প যেখানে ভগবান হনুমান কেবল সীতাকেই খুঁজে পাননি, রামায়ণে নিষ্ঠুর রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ভগবান রামকে সবরকম ভাবে তিনি সাহায্য করেছিলেন।

                   সুন্দরকান্ড শেষ 

  • সুন্দরকান্ড পাঠের উপকারিতা [ Benifits of reciting of Sundarkand ] :

সুন্দরকান্ড পাঠ মানুষকে সমস্ত সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে। আজ আমরা আলোচনা করব সুন্দরকান্ড পাঠের উপকারিতা। সুন্দরকান্ড পাঠের উপকারিতা আমরা দুভাবে আলোচনা করব। 

1. বৈজ্ঞানিক উপকারিতা।
2. আধ্যাত্মিক উপকারিতা।

বৈজ্ঞানিক উপকারিতা :

কেবল শাস্ত্রীয় বিশ্বাসই নয়, বিজ্ঞান সুন্দরকান্ডের পাঠ্যের গুরুত্বও ব্যাখ্যা করেছে। বৈজ্ঞানিক ভাবে যেকোন মন্ত্র কারও মানসিক শক্তি ও শক্তি বিকাশ, মানসিক চাপ কমিয়ে আনা এবং একজনকে উচ্চতর স্তরের চেতনায় নিয়ে যেতে সহায়তা করে। সুন্দরকান্ড নিয়মিত পাঠ বা অন্য কোন মন্ত্র নিয়মিত পাঠ করলে ভয়, ক্রোধ ও হতাশাকে মুছে ফেলা যায়। এছাড়া শ্বসন, হজম, প্রজনন, সংবহন, বৌদ্ধিক এবং জ্ঞানীয় তন্ত্র গুলি যে কোন ব্যাধি থেকে মুক্তি দিতে পারে। বৈদিক মন্ত্র বা হনুমান চালিশা বা সুন্দরকান্ড পাঠ করতে বলা হয় কারণ কারও মানসিক শক্তি বিকাশ ঘটিয়ে মানসিক চাপ কমিয়ে আনে এবং একজনকে উচ্চতর স্তরের চেতনায় নিয়ে যেতে সহায়তা করে। এছাড়াও কারও স্মৃতি শক্তির বিকাশ ঘটায়।

বিভিন্ন মনস্তত্ত্ববিদদের মতে সুন্দরকান্ড পাঠে ভক্তের আস্থা ও ইচ্ছা বৃদ্ধি করে। সুন্দরকান্ড আপনাকে শেখায় যে কোনও ব্যক্তি কীভাবে জীবনের প্রতিটি অসুবিধা এবং কঠিন পরিস্থিতির উপরে জয়লাভ করতে পারে যদি সে সাহসীকতার সঙ্গে সবকিছু মোকাবেলা করতে পারে। এই পাঠের প্রতিটি লাইন এবং এর সাথে যুক্ত অর্থ ভক্তকে জীবনে কখনও কোন পরিস্থিতিতেই হাল ছাড়ার কথা বলে না।মনোবিজ্ঞানীদের মতে, আপনি যদি বড় পরীক্ষায় সফল হতে চান, তবে পরীক্ষার আগে অবশ্যই আপনার সুন্দরকান্ড পড়া উচিত। প্রত্যেক ছাত্র ছাত্রীকে বিশেষ বিশেষ দিনে  সুন্দরকান্ড পাঠ করা উচিত। এই পাঠ তাদের মধ্যে আস্থা জাগিয়ে তুলবে এবং তাদের সাফল্যের আরও কাছে নিয়ে যাবে।

আধ্যাত্মিক উপকারিতা :

  • আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখা যায় তবে এই পাঠটি বাড়ির সমস্ত সদস্যের ওপর অশুভ গ্রহগুলির প্রভাব থেকে মুক্তি দেয়।
  • এটি ব্যক্তির জীবন থেকে সমস্ত নেতিবাচকতা এবং বাধা অপসারণ করে এবং ব্যক্তিকে সুখ এবং সমৃদ্ধি প্রদান করে।
  • ব্যক্তির আর্থিক অবস্থার উন্নতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • এটি ব্যক্তির রোগ ব্যধি থেকে রক্ষা করে এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হন।
  • যে ব্যক্তি নিয়মিত সুন্দরকান্ড পাঠ করেন তিনি মানসিক ভাবে সুখ শান্তির অধিকারী হন।
  • যেকোন ভূত প্রেত বা কোন নেতিবাচক শক্তির জন্য ভুগছেন বলে বিশ্বাস করেন তবে এটি পাঠ করতে পারেন। 
  • আপনি যদি কোন কাজে বার বার অসফল হন তবে সুন্দরকান্ড পাঠ করলে সেই কাজে সফলতা আসবেই।

নির্দিষ্ট সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সুন্দরকান্ড পাঠ [ Sundarkanda Chapters to get rid of certain problems ] :

  1. দরিদ্রতা দূর করতে এবং সংসারে সুখ সম্বৃদ্ধি আনতে সুন্দরকান্ড খুব উপযোগী।সম্পদ এবং সুখ পেতে পঞ্ছদশ অধ্যায়টি নিয়মিত তিন মাস পড়ুন।
  2. নিয়মিত সুন্দরকান্ড ত্রয়োদশতম অধ্যায় পাঠ মস্তিষ্কের প্রখরতা বৃদ্ধি করে। যেকোন ছাত্র ছাত্রী নিয়মিত এই অধ্যায়টি পাঠ করলে পরীক্ষায় ভাল করে। 
  3. ভূত, পিশাচ এবং শয়তানী আত্মার প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে তৃতীয় অধ্যায়টি পড়া যেতে পারে।
  4. কোন অবৈধ সম্পর্ক সম্পর্কিত পাপ মুক্তি করতে সপ্তম থেকে একাদশতম অধ্যায় নিয়মিত পাঠ করা উচিত। 
  5. আপনি কি জীবনে সুখ এবং শান্তি খুঁজছেন? জীবনে সুখ শান্তি পেতে প্রথম অধ্যায়টি পড়ুন।
  6. বাড়ি, জমি ইত্যাদির মতো সম্পদের উন্নতির জন্য 54তম অধ্যায়টি নিয়মিত পড়ুন।
  7. শত্রুদের পরাস্ত করতে বা শত্রুদের দূরে ভাগাতে এই পাঠর 42 থেকে 47 তম আধ্যায় পাঠ করা উচিত।
  8. আসন্ন বিপদ থেকে মুক্তি পেতে অধ্যায় 36 পড়ুন।
  9. হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়দের সাথে পুনরায় ফিরে পেতে  অধ্যায় 33 থেকে 40 তম অধ্যায় পড়ুন।
  10. আত্মীয়স্বজন বন্ধুদের বা অফিসে ভাল ব্যবহার পেতে অধ্যায় 20-21 পড়ুন।
  11. আপনার যদি খারাপ স্বপ্ন আসে রোজ রাতে তবে 27 তম অধ্যায় নিয়মিত পড়ুন।
  12. ঈশ্বরের উপলব্ধি পেতে 19 তম অধ্যায় পাঠ করুন।
  13. আপনি আপনার মনের শুভ বাসনা পূর্ণ করতে চাইলে 41 তম অধ্যায়টি পড়ুন।


সুন্দরকান্দ পড়ার সময় কোন রীতি অনুসরণ করতে হয় [ What is the procedure to be followed while reciting Sundarkanda ] :

  • আপনি যদি একা পাঠ করবার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তবে ভাল হয় আপনি ভোর 4-6 টার দিকে “ভ্রহ্মমুহুরত” তে পাঠ করতে পারেন।
  • যদি কয়েকজন মিলে একটি গ্রুপে সুন্দরকান্ড পাঠ করবার সিদ্ধান্ত নেন তবে যে কোনও সময় করা যায় তবে সন্ধ্যা 7 টার পরে সর্বাধিক ফল দায়ক।
  • সংগীত নিয়ে কয়েকজন মিলে একটি গ্রুপে  সুন্দরকান্ড পাঠ আদর্শ।
  • মঙ্গলবার এবং শনিবার ভোর পাঁচটা নাগাদ পূর্ণিমার দিন কয়েকজন মিলে সংগীত আকারে পাঠ করতে হয়।
  • সুন্দরকান্ড পড়ার সময় কোন রুপ ছেদ বা ব্রেক করা উচিত নয়। পড়তে পড়তে একেবারেই উঠে আসা উচিৎ নয়। আপনি আপনার মোবাইল ফোনটি অবশ্যই বন্ধ রাখবেন।
  • অর্থ বুঝে সুন্দরকান্ড পাঠ তাত্ক্ষণিক ফল দেয়।
  • সুন্দরকান্ড শুরু করার আগে স্নান করা উচিত এবং হালকা রঙের পোশাক পরা উচিত। যদি সম্ভব হয় তবে লাল পোশাক পড়ে লাল আসনে বসে পাঠ করা উচিৎ।
  • খালি পেটে সুন্দরকান্ড করা উচিত এবং শনিবার বা মঙ্গলবার উপবাস সর্বাধিক উপকার দেয়।
  • মহিলারা ঋতু স্রাবের সময় সুন্দরকান্ড পাঠ থেকে বিরত থাকবেন।






Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *