মৃত্যু মানুষের একমাত্র নিশ্চিত সত্যি যার থেকে মুক্তি নেই ধনী দরিদ্র কারোরই। কিন্তু আপনি জানলে অবাক হবেন আমাদের শাস্ত্রে মোট আট জনের চিরঞ্জিবী হবার কথা বলা রয়েছে। অর্থাৎ যারা আজও আমাদের মধ্যে সশরীরে বর্তমান রয়েছেন।
হিন্দু শাস্ত্রে এই আট চিরঞ্জীবি সম্পর্কে একটি শ্লোক রয়েছে। সেটি হল এই রকম :
“অশ্বত্থামা বালী ব্যাসো হনুমানশ চ বিভীষন কৃপাচার্য চ পরশুরামম সপ্তাইতা চিরঞ্জিভিয়ানম্ “
অর্থাৎ অশ্বত্থামা, রাজা মহাবালী, ব্যাস, হনুমান, বিভীষণ, কৃপাচার্য এবং পরশুরাম হলেন সাতজন চিরঞ্জিবী। এর সঙ্গে ঋষি মার্কান্ডেয় মহাদেবের বরে অমরত্ব লাভ করেছিলেন। আজকে আমরা জেনে নেব এক এক করে এই আট চিরঞ্জিবী সম্পর্কে।
অশ্বত্থামা :
Ashawatthama |
[ আরও পড়ুন : চাকরি পাওয়ার জন্য শক্তিশালী হনুমান মন্ত্র ]
মহাবালী :
Maha Bali |
ভিরোচনের পুত্র এবং প্রহ্লাদের পৌত্র মহাবালী অসুর বংশোদ্ভূত ছিলেন। তিনি তিন জগতের ওপর প্রভুত্ব কায়েম করতে অশ্বমেদ যোজ্ঞের আয়োজন করেন যা তাকে ভগবান ইন্দ্রের সমান ক্ষমতা প্রদান করত। এতেই স্বর্গের সমস্ত দেবতা ভীত হয়ে ভগবান বিষ্ণুর দ্বারস্থ হন। ভগবান বিষ্ণু যজ্ঞ চলা কালীন ভিক্ষুক ব্রাহ্মনের বেশে বালীর কাছে উপস্থিত হন এবং তিনি তিন পা জমি ভিক্ষা হিসেবে চান। দয়ালু বালী কোন দিনই তার কাছে আসা সাহায্য প্রার্থীকে খালি হাতে ফেরত পাঠাতেন না। বিষ্ণু অবতার বামন তাঁর দুটি পদক্ষেপ নিয়ে সমস্ত পৃথিবী এবং স্বর্গকে অতিক্রম করে ফেলেন। বালী বুঝতে পারেন যে একোন সাধারন ভিক্ষুক নন। তৃতীয় পদক্ষেপের জন্য বালী তার মস্তক ভিক্ষুকের চরন তলে রাখেন এবং ভিক্ষুক রুপী বিষ্ণু তাকে পাতাল লোকে প্রেরন করেন। বালির নিঃস্বার্থ ভক্তি, ধর্ম এবং অটল কথার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণু তাঁকে অমরত্ব প্রদান করেন এবং তিনি বছরে একবার পৃথিবীতে আসার বর লাভ করেন। এই মহাবালীর মর্তে আসার উপলক্ষে কেরালায় প্রতি বছর ওনম উৎসব উদযাপিত করা হয়।
[ আরও পড়ুন : ভগবান হনুমান কি এখনও বেঁচে আছেন? ]
ঋষি মার্কান্ডেয় :
Markendeya |
Pic : wikimedia
শিব এবং বিষ্ণুর উপাসক ঋষি মার্কান্ডেয় ভৃগু বংশের মানুষ ছিলেন। পিতা ছিলেন মৃকান্ডু এবং মাতা মারুদমতি। ঋষি মার্কান্ডেয়র পিতা মাতা এক পুত্র সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে শিবের উপাসনা করেন। এর ফল স্বরুপ তার পিতা দুটো বরের মধ্যে যেকোন একটি বর বেছে নিতে হত। বর দুটি হল হয় তিনি এক প্রচণ্ড বুদ্ধিমান এক পুত্র সন্তান লাভ করবে যার জীবন কাল হবে অতি সামান্য নয়ত তিনি এক স্থূল বুদ্ধি সম্পন্ন সন্তান জন্ম দেবেন কিন্তু তার জীবনকাল হবে দীর্ঘ। পিতা মৃকান্ডু প্রথম পছন্দটিকে বেছে নেন এবং ঋষি মার্কান্ডেয়র জন্ম দেন। তার জীবনকাল স্থির হয় মাত্র ষোল বছর।
মারকান্ডেয় শিবের এক মহান ভক্ত হিসাবে বড় হয়ে ওঠেন এবং তাঁর নির্ধারিত মৃত্যুর দিন তিনি শিবলিঙ্গকে জড়িয়ে ধরে নিরন্তর রূপে উপাসনা করতে থাকেন। যম দূতেরা তার জীবন কেড়ে নিতে এলে তিনি নিরন্তর শিবলিঙ্গকে জড়িয়ে ধরে উপাসনা করতে থাকলে তারা তার প্রান নিতে ব্যর্থ হন। এরপর যমরাজ নিজে আসেন মার্কান্ডেয়র জীবন কেড়ে নিতে। যমরাজ মার্কান্ডেয়র গলায় ফাঁস দিতে গেলে সেই ফাঁস গিয়ে পড়ে শিবলিঙ্গে। এতে মহাদেব যমরাজের ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং তার ওপর আক্রমণ করেন। দুজনের ভয়ংকর যুদ্ধ হয় এবং মহাদেব যমরাজের প্রান নিতে উদ্ধত হলে যমরাজ ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং প্রান ভিক্ষা করেন। শিব তার ধর্মপ্রাণ ভক্তের প্রান রক্ষার বিনিময়ে যমরাজকে প্রান ভিক্ষা করেন।
[ আরও পড়ুন : পবন পুত্র হনুমানের দশটি অজানা গল্প ]
পরশুরাম :
Parsurama
Pic : Wikimedia |
সমস্ত অস্ত্র সস্ত্র এবং দৈব শক্তি মম্পন্ন পরশুরাম ছিলেন বিষ্ণুর অবতার। মাতা ছিলেন রেনুকা এবং পিতা যামাদাগনি যিনি সপ্ত ঋষির মধ্যে একজন। ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও, তিনি অন্যান্য ব্রাহ্মণদের থেকে অনেকটা ভিন্ন ছিলেন। পরিবর্তে, পরশুরাম নিজের মধ্যে একটি ক্ষত্রিয়ের বৈশিষ্ট্য বহন করতেন, যার মধ্যে আগ্রাসন, যুদ্ধ এবং বীরত্ব অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুতরাং, উভয় বংশেরই দক্ষতার কারণে তাকে “ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয়” বলা হয়। তিনি তার বিখ্যাত কুঠারটি মহাদেবের কাছ থেকে পেয়ছিলেন। অন্য আর সাত অবতারের মতো, ভগবান পরশুরাম আজও পৃথিবীতে অমর । তিনি ভগবান বিষ্ণুর আভেশা অবতার। এই আভেশা অবতার হল ভগবানদের বিভিন্ন অবতারের একটি প্রকার বিশেষ। এইরূপ অবতারে, বিষ্ণু রাম বা কৃষ্ণের অবতারে সরাসরি অবতীর্ণ হন না বরং পরিবর্তে তাঁর রূপ দিয়ে কোনও মানুষের আত্মায় প্রবেশ করেন। মহাভারতে ভগবান পরশুরাম যোদ্ধা কর্ণের গুরু ছিলেন। লোককাহিনী অনুসারে, পরশুরাম শ্রীকৃষ্ণকে সুদর্শন চক্র দিয়েছিলেন। এটি বিশ্বাস করা হয় যে বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতারের মূল লক্ষ্যটি ছিল সেই সমস্ত পাপী ও অপ্রত্যাশিত রাজা যারা তাদের কর্তব্য অবহেলা করে তাদের হত্যা করে পৃথিবীর বোঝা মুক্ত করা। কলকি পুরাণে বর্ণিত রয়েছে যে পরশুরাম এখনও পৃথিবীতে অমর হয়ে রয়েছেন। এতে বলা হয়েছে যে পরশুরাম হবেন শ্রী কাল্কির প্রধান গুরু, যিনি ভগবান বিষ্ণুর শেষ অবতার হয়ে অবতীর্ণ হবেন।
[ আরও পড়ুন : কোন Hanuman Photo বাড়িতে লাগাবেন? ]
বিভীষণ :
Bibhisana |
রাক্ষস রাজ রাবণের ভ্রাতা বিভীষন হলেও তিনি রাম রাবণের যুদ্ধে প্রভু রামের পক্ষ নিয়েছিলেন। রাবণ যখন সীতা মাতাকে অপহরণ করে আটক করে রাখে তখন বিভীষন রাবণকে আদেশ করেন যে এখুনি সীতাকে মুক্ত করে রামের কাছে ফেরত দিতে। রাবণ তার কথা অমান্য করাতে তিনি রাবণের এই অন্যায় একদম মেনে নিতে পারেন নি এবং রাবণের পক্ষ ত্যাগ করে রামের কাছে যান। পরবর্তীতে তিনি শ্রীরামকে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে কৌশলগত ভাবে অনেক সাহায্য করেন। যুদ্ধ শেষে শ্রীরাম বিভীষণকে লঙ্কার অধীশ্বর করেন। লঙ্কার অধীশ্বর হয়ে তিনি অনেক প্রজা কল্যাণমূলক কাজ করেন। বিভীষণ যখন লঙ্কার রাজার পদ লাভ করেন, তখন তিনি তাঁর প্রজাদের মন্দ কাজের পথ থেকে ধর্মের পথে চালিত করেছিলেন। এই প্রচেষ্টাতে তাঁর স্ত্রী রানী সরমাও তাকে সহায়তা করেছিলেন। ত্রিজাতা নামে তাঁর একটি কন্যাও ছিল। রাম অবতারের শেষে ভগবান বিষ্ণু বিভীষণকে পৃথিবীতে থাকতে এবং লোকদের সেবা এবং সত্য ও ধর্মের পথে পরিচালিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
[ আরও পড়ুন : পাঁচটি বিস্ময়কর হনুমান মন্দির ]
হনুমান :
Hanuman |
হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ অনুসারে, শিবের একাদশতম রুদ্র অবতার হনুমান অঞ্জনা এবং পিতা কেশারীর কোলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। হনুমানের জন্মে বায়ুর ভূমিকা ছিল বলে হনুমানকে বায়ু পুত্র বলা হয়।
বাণর রাজ সুগ্রীব সেনাপতি বাল ব্রহ্মচারী হনুমান ছিলেন শ্রীরামের পরম ভক্ত। তিনি রাম রাবণের যুদ্ধে শ্রীরামের হয়ে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। রাবণ সীতা মাতাকে হরণ করে নিয়ে গেলে হনুমান রাক্ষস সেনার সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। তিনি রামের ভ্রাতা লক্ষণের প্রান রক্ষা করে ছিলেন সঞ্জীবুনী বুটি নিয়ে এসে। একবার রাবণের নির্দেশে রাবণ ভ্রাতা অহিরাবণ ছল করে রাম ও লক্ষণকে পাতাল পুরীতে আটক করে রাখলে তিনি পাতাল পৌছে তাদের মুক্ত করেন। রাবণের দর্প চূর্ণ করতে তার ল্যাজ দিয়ে লঙ্কা পুরী জ্বালিয়ে দেন। শ্রীরাম ইহলোক ত্যাগ করবার আগে হনুমানকে এই ইহলোকেই অমরত্ব আশীর্বাদ করে যান যাতে তিনি এই লোকের ভক্তদের রক্ষা করতে পারেন। তাকে নিয়েই তুলসীদাস হনুমান চালিশা রচনা করেন যা যুগে যুগে ভক্তদের কাছে সমাদৃত হয়ে এসেছেন।
[ আরও পড়ুন : মহিলারা কি হনুমান পূজা করতে পারে অথবা Hanuman Chalisa পাঠ করতে পারে? ]
বেদ ব্যাস :
Veda Vyasa
Pic : Wikipedia |
মহাভারত এবং শ্রীমদ্ভাগবতমের রচয়িতা ব্যাস দেব আট চিরঞ্জিবীর মধ্যে একজন।তিনি বুদ্ধি এবং জ্ঞানের প্রতীক বলে বিবেচিত হন। তিনি পিতা ঋষি পরাশর এবং মাতা সত্যবতীর সন্তান ছিলেন। তার পিতামহ ঋষি বশিষ্ট। তিনি ত্রেতাযুগের শেষে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সম্পূর্ণ দ্বাপরয়ুগ দেখতে বেঁচে ছিলেন এবং কলিযুগের প্রথম পর্বটিও দেখেছিলেন বলে হিন্দু শাস্ত্রে অনুমান করা হয়। গুরু পূর্ণিমার উৎসব তাঁকে উত্সর্গীকৃত। ওই দিন তার জন্ম বলে হিন্দু শাস্ত্রে মনে করা হয়। ঐ দিনটি ব্যাস পূর্ণিমা নামেও পরিচিত।
[ আরও পড়ুন : বাংলায় Bajrang Baan পাঠ ]
কৃপাচার্য :
Kripacharya |
মহাভারতের অন্যতম চরিত্র কৌরবদের সমর শিক্ষক কৃপাচার্য আট চিরঞ্জিবীর মধ্যে একজন। তিনি কৌরব যুবরাজদের যুদ্ধ শিক্ষা দিতেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধান্তে তিনি অর্জুনের পৌত্র পরিক্ষিতকেও অস্ত্র শিক্ষা দেন।
কৃপাচার্য নিজেও এত বড় যোদ্ধা ছিলেন তার সম্পর্কে মহাভারতে বলা হয়েছে তিনি একবাড়ে ষাট হাজার শত্রুকে পরাস্ত্র করতে পারতেন। সাহসিকতার সাথে যুদ্ধের লড়াইয়ে তিনি কেবল শিবের পুত্র কার্তিক্যের সাথে তুলনা করেছেন, যিনি অসুরদের জয় করেছিলেন। কৃপাচার্যকে অমরত্ব প্রদান করেন ভগবান কৃষ্ণ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃপাচার্য সত্য, ধর্ম এবং নিরপেক্ষতার মতো মহান গুণ প্রদর্শন করেছিলেন এমনকি অত্যন্ত মানসিক চাপের মধ্যেও তিনি তার মূল্যবোধের সাথে আপস করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। এক্ষেত্রে কৃপাচার্য সমগ্র মানব জাতির কাছে মহান হয়ে উঠেছেন।
উপরি উক্ত আলোচনাতে আমরা আটজন চিরঞ্জিবী সম্পর্কে জানলাম। শাস্ত্রে বলা রয়েছে এই আটজন চিরঞ্জিবীর নাম সকাল সকাল স্মরণ করলে ঐ ব্যক্তি যে কোন রোগ ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকেন এবং একশত বছর জীবিত থাকেন। এনিয়ে শাস্ত্রে একটি শ্লোক রয়েছে :
” অশ্বথামা বালিরব্যস্যো হনুমানশ্শ্চ বিভীষণাহকৃপা পরশুরামাসশ্চ সপ্ততেয় চিরঞ্জিভিনহসপ্তিতান সংস্মরন্যিত্যম মার্কণ্ডয়েমথ্যাষ্টমম জীবদেবশততম সোপি সর্বব্যধিভাবির্জিত “